সে দৃশ্য এখনও চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসতে থাকে এখনও হঠাৎ চমকে উঠি। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। সেদিন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর তা বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট মিলেই ঐ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেছিল। সরকার প্রধান নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। কোন পক্ষই প্রস্তাবিত কাউকেই মেনে নিতে চাচ্ছিলো না। আর সে কারণেই সংবিধানের বিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তার দায়িত্ব গ্রহণের পর শেখ হাসিনা বলেছিলেন, দেখা যাক উনি কতটা নিরপেক্ষভাবে কাজ করেন। আর আগেই তিনি তার সন্ত্রাসী সমর্থকদের এই বলে ডাক দিয়েছিলেন যে, তারা যেন ২৮শে অক্টোবরের মধ্যে লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকা শহরে এসে হাজির হন। কেন তারা লগি-বৈঠা নিয়ে আসবেন? আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হলো, তারা ঢাকা শহর অবরোধ করে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তাদের কথা মতো চলতে বাধ্য করবেন। সেভাবেই সব ঠিক ঠাক। আওয়ামী লীগের হাজার হাজার সন্ত্রাসী কাঁচা বাঁশের লাঠি আর নতুন কাঠের বৈঠা সদৃশ দণ্ড নিয়ে ঢাকায় এসে অবস্থান নিলো।
লগি-বৈঠাওলারা অবস্থান নিলো বিবি এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ অফিস ঘিরে। জামায়াত অবস্থান নিলো পুরানা পল্টন এলাকায়। বিএনপি অবস্থান নিলো নয়া পল্টনে তাদের অফিসের সামনে। ঢাকা শহর তখন যেন একটি অবস্থান আর দখলের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হলো। শক্তি প্রদর্শন যেন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ালো। আওয়ামী লীগের নেতা ওবায়দুল কাদের ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে এ বলে সর্তক করে দিলেন যে, তিনি যদি তাদের কথা মতো না চলেন, তা হলে ভঙ্গভবনের গ্যাস পানি বিদ্যুৎ এমন কি অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ করে দিবেন। ওবায়দুল কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। সম্ভবত তিনি পাস করেও বেরিয়েছেন। তিনি আল্লাহর আকাশে প্রবহমান বাতাস পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিলেন। কাণ্ডজ্ঞানহীনতা আর কাকে বলে! অর্থাৎ ক্ষমতায় যাবার জন্য আওয়ামী লীগ এমনি এক উন্মাদের দলে পরিণত হয়েছিল।
সুতরাং ঢাকার গুলিস্তান থেকে নয়াপল্টন পর্যন্ত এলাকাটিতে ছিল যেন যুদ্ধ যুদ্ধ একটি ভাব। লগি-বৈঠাওয়ারা জিপিও মোড় থেকে গুলিস্থান পর্যন্ত নানা উস্কানিমূলক স্লোগান দিতে দিতে লগি-বৈঠা হাতে মিছিল করছিল। পুরানা পল্টন এলাকায় খণ্ড খণ্ড মিছিল করছিল জামায়াত-শিবিরের নেতকর্মীরা। নয়া পল্টনে বিএনপি।
গোটা ঘটনাটাই সরাসরি সম্প্রচার করছিল বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল। কখনও তারা যাচ্ছিল নয়া পল্টনে। কখনও পুরানা পল্টনে। কখনও বিবি এভিনিউতে। আর সারাদেশের কোটি কোটি মানুষ টেলিভিশন পর্দার সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, কী ঘটে দেখার জন্য।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ঘটলো সেই নরহত্যাযজ্ঞের ঘটনা। নয়াপল্টন ও পুরানা পল্টনে যারা ছিলেন তাদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। আর আওয়ামী লীগ অফিস-কেন্দ্রীক মিছিলকারীদের প্রত্যেকের হাতে ছিল লগি আর বৈঠা। টেলিভিশনের ক্যামরা সচল ছিল। একদল লগি-বৈঠাধারী আকস্মিকভাবে ছুটে এলো পুরানা পল্টন মোড়ের দিকে। তাদের কারো কারো হাতে ছিল পিস্তল ও কাটা রাইফেল। ভিডিও চিত্রে তার প্রমাণ আছে। ছুটে এসেই তারা পুরানা পল্টনে অবস্থানরতদের ওপর হামলা চালালো। অনেকে এদিক ওদিক ছুটে গেল। কিন্তু পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সাদা পাজামা পানজাবি পরা তরুণ জসিম। সে পালাবারও চেষ্টা করেনি। যেন আরো বহু মানুষের মতো অপেক্ষা করছিল, কী ঘটে তা দেখার জন্য। কিন্তু আওয়ামী লগি-বৈঠাওয়ালার এক যোগে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সে দৌড়াবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আওয়ামী লেঠেলরা তাকে উপর্যুপরি পিটাতে থাকলো। সে বসে পড়েছিল। তার পর পড়ে গেল মাটিতে। তার সারা শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। সে শেষ বারের মতো উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল। তখন তাকে আবারও একই রকম নৃশংসভাবে পিটিয়ে মাটিতে ফেলে দিল আওয়ামী লীগের খুনিরা। আর একজন খুনি রক্তাক্ত বৈঠা হাতে তার লাশের উপর দাঁড়িয়ে নৃত্য করছিল। পায়ের দিকটায় পিটাচ্ছিল অন্য খুনিরা।
টেলিভিশন ক্যামেরায় এই পুরো দৃশ্য লাইভ দেখানো হচ্ছিল। যে রিপোর্টার ধারাবিবরণী দিচ্ছিলেন, বেদনায় আতঙ্কে তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল। ক্যামরাম্যান বার বার চোখ মুছছিলেন। রিপোর্টার কান্নায় এতোটাই ভেঙ্গে পড়ছিলেন যে তার কণ্ঠ থেকে আর কোনো স্বর বের হচ্ছিলো না। তিনি শুধু কেঁদেই যাচ্ছিলেন। টেলিভিশনের সামনে যারা শিশুদের নিয়ে বসে অনুষ্ঠান দেখছিলেন, তারা দ্রুতই শিশুদের চোখে মুখে হাত রেখে চাপিয়ে দিচ্ছিলেন, যেন দৃশ্যটি তারা দেখতে না পায়। অনেকেই টেলিভিশনের সামনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন- যেন এটি ভিয়েতনামের মাই লাই হত্যাকাণ্ড, যেন বাংলাদেশ এক মৃত্যুর উপত্যকা।
শুধু জসিমই নয়, ঐদিন এভাবে আরও প্রায় আধ ডজন তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল আওয়ামী ঘাতকরা। সারা বাংলাদেশে, শুধু সারা বাংলাদেশেই বলি কেন, সারা পৃথিবীতেই এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর নিন্দার ঝড় উঠেছিল। কিন্তু আহ্লাদিত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা, রাশেদ খান মেনন আর হাসানুল হক ইনু। তারা একযোগে বলতে শুরু করলেন যে, পুরানা পল্টনের ছেলেরাই লগি-বৈঠাওলাদের প্রতি গুলি ছুঁড়েছিল। আর তাই আত্মরক্ষা করতে লগি-বৈঠাওলারা এমন কাজ করেছে। অর্থাৎ এই পৈশাচিকতা সমর্থন করে বসলেন এই সব রাজনৈতিক নেতা। তাদের এই বক্তব্যে বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষসহ সারা পৃথিবীর মানুষ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।
সেই সব পরিবারে আজও নিশ্চয়ই কান্নার রোল ওঠে। দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হয়। এই সব অশ্রু আর দীর্ঘশ্বাসের ভার বাতাস- সেও বহমান। ওবায়দুল কাদের ভঙ্গভবনের অক্সিজেন বন্ধ করে দিতে চিয়েছিলেন। আল্লাহতালার বাতাস বন্ধ করে দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। এই দীর্ঘশ্বাসবাহী ভারী বাতাসও একদিন ওবায়দুলদেরও স্পর্শ করে যাবে।
আজ আমি জসিমের এই শাহাদাতের দিনে জসিমসহ আরো যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করি। মহান আল্লাহতালা যেন তাদের বেহেস্ত নসিব করেন।
লেখক : ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
সাংবাদিক, কলামিস্ট