২৮ অক্টোবর সকাল ৬টায় এগারসিন্দুর এক্সপ্রেসে ঢাকার উদ্দেশে আসার পথে গাড়ি যখনই টঙ্গী থামলো সাথে সাথে লগি-বৈঠাধারি ৩০-৪০ জন যুবক ট্রেনের গ্লাসে এলোপাতাঁড়ি ভাঙচুর শুরু করল। সবাই চিৎকার শুরু করে এদিক সেদিক কেউবা জীবন বাঁচানোর জন্য জানালা দিয়ে বের হওয়া শুরু করল। মহিলা ও শিশুরা বাঁচাও বাঁচাও করে চিৎকার শুরু করল। আমি তখনও কিছু বুঝতে না পেরে এক পর্যায়ে দেখলাম ট্রেনের বগিতে কেউই নেই। সন্ত্রাসীরা গ্লাস ভাঙতে ভাঙতে আমার বগির দিকে যখন এলো তখনও চুপ করে বসেছিলাম। ভাবলাম যা হওয়ার হবে আল্লাহ ভরসা। একটু পরই জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে ওরা পুলিশের টেয়ার শেল খেয়ে চলে গেল। বৈঠাধারি যুবকদের দেখে বুঝতে পারলাম না ওরা কারা। তবে এদের চেহারা দেখে মনে হলো এরা ‘টোকাই লীগ’। একটু পরে পুলিশ ও বিডিআরের সহায়তায় ট্রেন যথারীতি কমলাপুর এসে পৌঁছল।
কমলাপুর থেকে রিকসাযোগে অফিসে ঢোকা মাত্রই দেখলাম একের পর এক আহত অবস্থায় লোকজন অফিসের দিকে আসছে। অফিসে তখন দেখলাম সেক্রেটারিয়েট ভাইয়েরা বসছেন। কথা না বলে চুপ করে বৈঠকে বসে গেলাম। কেন্দ্রীয় সভাপতি তৎক্ষণাৎ বললেন, আর বসে থাকা যায় না, আসুন সবাই বের হয়ে পল্টনের দিকে যাই। অফিস থেকে বের হয়ে আমরা এক সাথে যাচ্ছি। রেজাউল করিম ভাই বললেন, রোকন ভাই আপনি কেন্দ্রীয় সভাপতির সাথে সার্বক্ষণিক থাকবেন, আমরা যাচ্ছি পল্টন মসজিদের দিকে। কেন্দ্রীয় সভাপতির সাথে চলে গেলাম পল্টন ময়দানে। কি হৃদয়বিদারক দৃশ্য! নিজেকে আর সামলিয়ে নিতে পারলাম না। হাজার হাজার লগি-বৈঠাধারি লোক। মনে ভরসা ও বিশ্বাস ছিল যে ওরা যাই করুক না কেন, এক পর্যায়ে তারা পালাবেই। হঠাৎ দেখলাম আমাদের নিকট থেকে ৮-১০ হাত দূরে যেখানে তানভীর নামে ১২-১৪ বছরের একটি ছেলে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। তার রক্তাক্ত মুখে হাত দিয়ে বললাম, কাঁদছো কেন? তখন সে মায়াজ-মোয়াজের মত চিৎকার করে বলল, ‘আমাকে আহত অবস্থা যুদ্ধের ময়দান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন? আমি তো আহত হয়ে যাওয়ার জন্য আসিনি। আমাকে ছেড়ে দিন আমি যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হবো। তার এ অনুভূতি দেখে তখনই আমার মনে হচ্ছে আজ আমাদেরই বিজয় হবে। কেন্দ্রীয় সভাপতির সাথে থেকে কোন ময়দানে বাতিলের মোকাবেলা এটাই আমার প্রথম সৌভাগ্য মুহূর্ত। সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সরাসরি ময়দানে মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় সভাপতির যোগ্যতা, বিচক্ষণতা আর সাহসিকতা দেখে আমার নতুন করে অনেক কিছু শেখা হল। একবার আমীরে জামায়াতের বক্তৃতার ঠিক আগ মুহূর্তে পাশের ছাদের ওপর দিকে একটি ইটের টুকরা কেন্দ্রীয় সভাপতির দিকে ছুটে আসছে। আমি বললাম মাসুদ ভাই একটু মাথাটা সরে দাঁড়ান, তিনি তখন চিৎকার করে বললেন, না। তৎক্ষণাৎ টুকরাটি তার ডান হাতে এসে পড়ল। পরক্ষণেই শুরু হল বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ। তখন কেন্দ্রীয় সভাপতি সবাইকে অভয় দিয়ে বললেন, কেউই এখান থেকে যাবেন না। একটু পরই গুলি থেমে যাবে, ওরা টিকতে পারবে না, বাতিলের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। যেই কথা সেই কাজ। মুহূর্তে তাদের পক্ষ থেকে আর গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তিনিই ময়দান মোকাবেলায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে তার সাথে থাকতে পেরে আমি নিজেকে গৌরবান্বিত বোধ করছি। এভাবে তার বিচক্ষণ নেতৃত্বে সন্ধ্যা পর্যন্ত পল্টনে আমাদের চোখের সামনে হয়ে গেল শহীদ, আহত হল হাজার হাজার দীনি মুজাহিদ। সন্ধ্যার পর যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হল তখন এডভোকেট মশিউর রহমান ভাইয়ের নেতৃত্বে শুরু হল মামলার কার্যক্রম। এডভোকেট কামাল ভাই এবং রাজ্জাক ভাই, এডভোকেট ফরিদ ভাই, এডভোকেট শিশির মনিরসহ আরো অনেকের সহযোগিতায় পল্টন থানায় মোট ৩টি ও শাহবাগ থানায় ১টি মামলা রুজু করা হয়।
মামলার কাজ শেষ করে আমরা চলে যাই জামায়াতে ইসলামীর আরেক নির্ভীক দায়িত্বশীলের সাথে তিনটি হাসপাতালে থাকা রোগিদের দেখতে ও খোঁজখবর নিতে। সেই ভাইয়ের সাথে হাসপাতালে যাওয়ার পথে আমি বললাম, আপনার ছেলে পল্টনে ছিল সেই সময়ে তার খোঁজ নিয়েছিলেন কি না। তখন উত্তরে তিনি বললেন, না আমি তার খোঁজ নেয়ার সুযোগ পাইনি। ছেলের মা আমাকে খোঁজ নিতে বলল, কিন্তু আমি চিন্তা করলাম আমি যদি শুধু আমার ছেলের খোঁজ নেই তাহলে তার প্রতি আমার পিতা হিসেবে ভালবাসার সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের হযরত ইসমাইল (আ.) এর প্রতি হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর কথা। তৎক্ষণাৎ সেই দায়িত্বশীল ভাই ছোট ছেলেদের ন্যায় কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং বলেন, আহত অন্যসব ভাইদের খোঁজ নেয়ার দায়িত্বও আমার। তার পর তিনটি হাসপাতালে গিয়ে একজন একজন করে খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করলাম। সে দায়িত্বশীল ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগরী ও কেন্দ্রীয় ছাত্রকল্যাণ বিভাগের স্বেচ্ছাসেবক ভাইদের ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বললেন, হাসপাতালের সকল আহত ভাইদের চিকিৎসার ব্যাপারে যা করণীয় সকল কিছু সংগঠনের পক্ষ থেকে দায়িত্ব আমার। যে কোন সমস্যার ব্যাপারে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।
পরের দিন শহীদ পরিবারের সাথে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন। শহীদদের মা-বাবার অনুভূতি দেখে মনে হলো তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা-বাবা। ঘটনার তিন দিন পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে ২৮ অক্টোবর শহীদ পরিবারের সাক্ষাৎ। আমার হাতে থাকা সকল শহীদ পরিবারের নাম ও বিস্তারিত ঠিকানাসহ ফাইলটি কেন্দ্রীয় সভাপতির কাছে দিলাম। জনাব কেন্দ্রীয় সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সকল সম্মানিত গর্বিত শহীদ পরিবারকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি সবচেয়ে অবাক হয়ে গেলাম পরদিন কয়েকটি জাতীয় দৈনিক যেগুলোর নাম লিখে আমি এই স্মরণিকাটিকে অপবিত্র করতে চাই না, দৈনিকগুলোতে বলা হলো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাথে ২৮ অক্টোবর নিহত বোরকা পরে মিথ্যা আত্মীয়-স্বজন সেজে দেখা করেছে। আমি সেই জঘন্য পত্রিকার সম্পাদক ও হলুদ একচোখা সাংবাদিকদের বলতে চাই, ২৮ অক্টোবরের শহীদের ঘটনা সারা বিশ্ববাসী জানলেও আপনারা যারা মিথ্যা বলছেন, ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আসুন আমাদের খরচে সকল শহীদের বাড়িতে আপনাদের নিয়ে যাবো। এই প্রস্তাবে কি আপনাদের সাড়া পাওয়া যাবে? এই প্রস্তাবে আপনারা আসবেন না। পরিশেষে বলতে চাই শহীদি এই কাফেলাকে সম্মানিত করা ও সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিজের। ২৮ অক্টোবরের ইতিহাস সত্যাশ্রয়ীদের রক্তক্ষরণের এক অধ্যায় হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক : শেখ মো: রোকন রেজা
সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রকল্যাণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির