Home Article ৭ বছরেও সুবিচার পায়নি শহীদ পরিবারগুলো

৭ বছরেও সুবিচার পায়নি শহীদ পরিবারগুলো

মাত্র ৭ বছর। পাল্টেনি দৃশ্যপট। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে রাজধানীর পল্টন ময়দানে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৬ নেতাকর্মীকে জনসম্মুখে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে আওয়ামী গুণ্ডাবাহিনী। সময় গড়িয়ে গেছে। ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর আবার এসেছে। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এখন আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দীর্ঘ সময়ে শহীদ পরিবারগুলো কোনো ধরনের সুবিচার পায়নি। উল্টো পরিবারগুলোর প্রতি নানা ধরনের হুমকি-ধামকি অব্যাহত রেখেছে আওয়ামী সরকার। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকার গঠনের পর রাজনৈতিক বিবেচনায় ২৮ অক্টোবরের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের মামলা এক তরফাভাবে প্রত্যাহার করেছে। ঐদিন নিহতদের পরিবারগুলোর ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা আর্তনাদ হয়ে নিভৃতে নীরবে কেঁদে মরছে।

শহীদ পরিবারের সদস্যরা জানান, খুনীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত তাদেরকে গুণ্ডাবাহিনীর দ্বারা নানা ধরনের হুমকির শিকার হচ্ছেন। তারা অনেক সময় নামাজে যেতেও সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। ব্যবসায়-বাণিজ্যে হচ্ছে ক্ষতির মুখোমুখি।

শহীদ পরিবারের প্রতিক্রিয়া : শহীদ জসিম উদ্দিনের বাবা আবদুর রশিদ খানের সাথে আলাপকালে জানা যায়, তিনি নিরাপত্তার অভাবে মসজিদে ফজরের নামাজ পড়তেও যেতে পারেন না। বেশ কয়েকবার স্থানীয় সন্ত্রাসীসের দ্বারা তিনি হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন। এখন নিরাপত্তাহীনতার কারণে মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে পারেন না। তিনি নিজের সংসারের অবস্থা তুলে ধরে বলেন, জসিম শহীদ হওয়ার পর থেকে আমার পরিবারে ব্যবসায়-বাণিজ্যে নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে। ব্যবসায়ীপার্টি মাল নিয়ে টাকা শোধ করতে গড়ি মসি করে। কোথাও গিয়ে বিচার পাচ্ছি না। আবদুর রশিদ বলেন, এখন জসিমের পরিবারসহ দুটি সংসার আমাকে দেখতে হচ্ছে। ব্যবসার অবস্থাও ভালো না। এ অবস্থায় সংগঠনের পক্ষ থেকেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।

জসিম সম্পর্কে তার আত্মীয় ইকবাল বলেন, জসিমের মতো এমন ভদ্র-মার্জিত লোক আমি জীবনে কোথাও দেখিনি। সে প্রতি মাসে একবার করে হলেও আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজখবর নিতেন। অত্র এলাকার কোনো একটি মানুষও তার বিরুদ্ধে কোনো দিন অভিযোগ করেনি। সে সবার সাথে উত্তম আচরণ করতো। অথচ এমন একটি ছেলেকে শুধুমাত্র ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে তরতাজা প্রাণটিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্য লগি-বৈঠা দিয়ে সাপের মতো পিটিয়ে মেরেছে। এমন ঘটনা হয়তো এটাই প্রথম। কিন্তু আফসোস হচ্ছে আমরা এর কোনো সুবিচার পেলাম না। উল্টো আমাদের পরিবারের প্রতি নানা ধরনের হুমকি-ধামকি অব্যাহত রয়েছে। আমরা কি এর কোনো বিচার পাবো এ পৃথিবীতে?

পবিত্র কুরআনের হাফেজ শহীদ গোলাম কিবরিয়া শিপনের বাবা মো. তাজুল ইসলাম বলেন, আমার সন্তানদের মধ্যে শিপন ছিল সবচেয়ে মেধাবী। আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না ওর দাখিল ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীার ফলাফল ঘোষণার পর সেই খবর জানানোর স্মৃতি। আমি মনে করি শিপনের শাহাদাত শুধু আমার বুকে সন্তান হারানোর বিয়োগ ব্যথাই সৃষ্টি করেনি, জাতি হারিয়েছে এক সম্ভাবনাময় তরুণকে। শিপন দাখিল পরীায় মেধাতালিকায় ১১তম স্থান অর্জন করেছিল। উচ্চ মাধ্যমিক পরীার ফলাফলেও ছিল তার কৃতিত্বের স্বার। শিপন ছিল পবিত্র কুরআনের হাফেজ, সে কুরআনের বাংলা করতে পারতো। শিপন যখন ওর সমবয়সী বন্ধুদের পবিত্র কুরআন অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ বুঝাতো তখন আমি আশ্চার্য হয়ে ভাবতাম আর মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতাম।

শিপনের মা মাহফুজা বেগম, সন্তান হারানোর শোকে যে মানসিক আঘাত পেয়েছেন, তার প্রতিক্রিয়ার কথা বলতে গিয়ে মাঝে মাঝে তার মুখ বাঁকা হয়ে যায়, তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান। তারপরও তিনি পাথরে বুক বেধে রেখেছেন, শহীদের জননী হিসেবে তিনি গর্বিত। ২০০৬ সালে ঈদুল ফিতরের আমেজ কাটার আগেই তিনি হারান তার প্রিয় সন্তান শিপনকে। শিপন ঈদ উপলে তার মায়ের জন্য চুড়ি কিনে এনে নিজ হাতে তাকে পরিয়ে দিয়েছিল। তাকে জিজ্ঞেস করেছে মা তোমার আর কি লাগবে, আমি তোমাকে তা এনে দেব। তোমাকে খুশি করতে পারলে আমার খুব ভালো লাগে। তিনি বলেছিলেন, বাবা আমার কিছু লাগবে না। এখনো তার কানে বাজে শিপনের মা মা ডাক। শিপনের মা বাবার দাবি ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামিদের সনাক্ত করে বিচার করা হোক। তারা বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে গণতন্ত্রের মুখোসের আড়ালে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির চর্চা চলতেই থাকবে। যতই রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলা হোক কোনো কাজে আসবে না। মাহফুজা বেগম বলেন, আমাদের ছেলে হত্যার বিচার পেলাম না। দেশে আইনের শাসন থাকলে হয়তো এ অবস্থার শিকার হতে হতো না।

শহীদ সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুমের বাবা মাহতাব উদ্দিন আহমদ বলেন, আমার ছেলের অপরাধ ছিল সে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করতো। এই এলাকার প্রতিটি মানুষ তাকে ভালোবাসতো। আমার বন্ধুবান্ধবরা এখনো আমাকে বলে, সত্যি তোমার ছেলে মাসুম ছিলো একটা হিরের টুকরো। সন্তান হারানো বাবা মার কষ্ট বুঝানোর কোনো ভাষা পৃথিবীতে আছে কি না তা আমার জানা নেই। আমার বুকে যে কি কষ্ট তা আমি বুঝাতে পারবো না। তারপরও সব কষ্ট ভুলে যাই যখন ভাবি আমি এক শহীদের পিতা আমার সন্তান জীবন দিয়েছে বাংলাদেশে আল্লাহ দেয়া জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার জন্য। আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে ওর নম্রভদ্র ব্যবহার, মাসুম ওর প্রয়োজনের কথা আমাকে জানাতো খুবই নম্র ও ভদ্র ভাষায়। ওর প্রতিটি কাজই ছিল নিখুঁত। মাসুমের শাহাদাতের পর ওর ডায়েরি দেখে আমি ভেবেছি, আল্লাহতায়ালা তার এমন বান্দাকে তো পছন্দ করবেনই। ওর ডায়েরির পাতায় প্রতিদিনের কাজ, মনের ভাবনা এবং কে কত টাকা পাবে সব লেখাছিল। আমরা বাসায় না থাকলে ওর বন্ধুবান্ধব আসলে সামনের দোকান থেকে অনেক সময় বাকীতে বিস্কুট, চানাচুর, এনে তাদের আপ্যায়ন করত। সে হিসাবও ওর ডায়েরিতে লেখা ছিল। শহীদ মাসুমের পিতা বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে তার সন্তান হত্যার বিচার চান। তিনি মনে করেন এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে ব্যর্থ হলে এ সরকারকে ইতিহাস কোনো দিন মা করবেনা। শহীদ মাসুমের মা শামসুন্নাহার বেগম বলেন, আমি শহীদ মাসুমের মা এটাই আমার সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা। যখন মাসুমের জন্য কান্নায় আমার বুক ভেঙে যায়, আমি দেখি আমার চেয়ে বেশি বেদনা ভারাক্রান্ত আমার প্রতিবেশীরা। তারা আমার চেয়ে বেশি কাঁদছে। তখন আমি আমার প্রিয় সন্তান হারানোর কষ্ট ভুলে গিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার শুকরিয়া আদায় করি। তিনি বলেন, সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন ২৮ অক্টোবরের নির্মম ও বর্বর হত্যাকাণ্ড গোটা পৃথিবী প্রত্য করেছে। ভিডিও ফুটেজে খুনীদের ছবি রয়েছে, খুনীরা এখনো আমাদের চোখের সামনে দিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপরও কেন সরকার ওদের বিচার করতে পারছে না? তাহলে কি আমরা ধরে নিবো খুনীদের সাথে সরকারের আঁতাত রয়েছে?

শহীদ মুজাহিদুল ইসলামের মা মাহমুদা দেলোয়ার মুন্নী বলেন, এত অল্প বয়সে আমার মুজাহিদকে আল্লাহ তায়ালা কবুল করবেন, আমি কোনোদিন ভাবিনি। তবে ও যে অন্য সবার চেয়ে আলাদা তা আমি পরিস্কার বুঝতে পারি। ওর চালচলন আচার আচরণ ছিল খুবই পরিশীলিত ও উন্নত। ইসলামী ছাত্র শিবিরের সদস্য হওয়ার পর সে প্রতি সপ্তাহে দু’দিন রোজা রাখতো। নিয়মিত তাহাজ্জদ নামাজ আদায় করতো। নামাজ শেষে মুনাজাত করতো শাহাদাতের দরজা লাভের জন্য। আমি এখন ভাবি আল্লাহ এত তাড়াতাড়ি ওর দোয়া কবুল করেছেন, কারণ ওর সাথে তাঁর সত্যি সত্যি খুব গভীর একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তাই তিনি ওকে কাছে নিয়ে নিয়েছেন শাহাদাতের মর্যাদা দিয়ে। মুজাহিদের শাহাদাতের পর আমি মাঝে মাঝে নফল রোজা রাখতাম। এখন আমারও সপ্তাহে দু’দিন রোজা রাখার অভ্যাস হয়ে গেছে। তিনি এ প্রতিবেদককে আরো বলেন, সারাদিন কাজে এত বেশি ব্যস্ত থাকি যে ওর কথা খুব একটা মনে হয় না। অন্যান্য আর দশটা দিনের মতো ঈদের দিনও তাই হয়েছে। রাতে ওর হাজারো স্মৃতি আমার মনে এসে ভীড় করে। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে নামাজ শেষে প্রায় প্রতিরাতে আল্লাহর দরবারে হাত তুলি, মুনাজাত করি ওর জন্য ওর বন্ধুদের জন্য। ইসলামী ছাত্রশিবিরের জন্য এ দেশের ইসলামী আন্দোলনের জন্য দোয়া করি, তখন মনটা হালকা হয়। তিনি আরো বলেন, মাহে রমজানে ইফতার আইটেমগুলোর মধ্যে আলুর চপ ছিল মুজাহিদের খুব প্রিয়। আমি ওর জন্য আলাদা করে চপ রেখে দিতাম, সে তারাবি নামাজ শেষে এসে আবার খেত। আমি বেসন ছাড়া ডিম দিয়ে বিশেষ ধরনের চপ বানাই এটা ওর প্রিয় খাবার। তাই যখন গত রমজানে আমি যখন চপ তৈরি করতে গিয়েছি ওর কথা বেশি বেশি মনে পড়েছেু। ওর বন্ধুদের চপ খাওয়াতে পারলে আমার খুব ভালো লাগে।

শহীদ হাবিবুর রহমান ছিলেন একজন ুদ্র ব্যবসায়ী। কিন্তু ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে তার কোনো অলসতা ছিল না। তিনি সব সময় মানূষকে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন। নিজে কুরআন হাদীস পড়তেন, পরিবার পরিজনকে পড়তে বলতেন। শত অভাবের মাঝেও তিনি সব সময় চেষ্টা করতেন হাসি মুখে থাকতে, পরিবারজনের সুখের জন্যও তিনি কঠোর পরিশ্রম করতেন। অশ্র“সজল চোখে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে উল্লিখিত কথাগুলো বলেন শহীদের স্ত্রী আছিয়া খাতুন। শহীদের কিশোরপুত্র মো. রুবেল ও শিশুকন্যা তানজিলার স্মৃতির কুঠিরে তার স্নেহময় বাবা হাবিবুর রহমান অম্লান হয়ে আছেন এবং থাকবেন। তারা কখনো তাকে ভুলতে পারে না। রুবেল স্বপ্ন দেখে সে তার বাবার আদর্শ ইসলামের আলোকে নিজেকে আলোকিত করে বড় হয়ে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবে। এ জন্য সে সবার দোয়া চায়। শহীদের শিশুকন্যা কোনো কথা বলতে পারলো না এ প্রতিবেদকের সাথে সে অতিশোকে পাথর। শহীদ হাবিবুর রহমানের পরিবার তার নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার চায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শহীদ পরিবারের সদস্য বলেন, আমাকে প্রায় দু’বছর ডিবি অফিস থেকে প্রতি মাসে চিঠি দেয়া হয়েছে যেন তাদের সাথে দেখা করি। আমি যাইনি। অবশেষে একদিন আমার কাছে এসে তারা বলেছে আমাদের উপর থেকে অর্ডার দেয়া হয়েছে আপনি যদি আমাদের প্রধান কার্যালয় মিন্টু রোডে না আসেন তবে আপনাকে আমরা তুলে নিয়ে যাব। তিনি বলেন, পরে আমি মান-সম্মানের দিকে লক্ষ্য রেখে ডিবি অফিসে গেলে তারা জোড় পূর্বক আমার কাছ থেকে স্বাক্ষর আদায় করে নিয়েছে মামলা প্রত্যাহারের ব্যাপারে। আমি অনেক আপত্তি করলেও তারা শুনেনি। উল্টো বলেছে আপনি স্বাক্ষর না দিলে আমাদের চাকরি যাবে। কেননা উপর থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আমরা যে কোনো মূল্যে যেন মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে আপনাদের রাজি করাই। তিনি আরো বলেন, আমরা হয়তো পৃথিবীতে সুবিচার পাব না। কিন্তু শেষ বিচারের দিন আল্লাহর আদালতে নিশ্চয় বঞ্চিত হবো না।

লেখকঃ ফারুক আহমাদ

SHARE