ক্ষমতালিপ্সুদের হিংসার থাবায় ২৮ অক্টোবর ২০০৬ রক্তরঞ্জিত হলো রাজধানীর কালো পিচঢালা রাজপথ। সত্যের সেনানীদের লাঠি-বৈঠার আঘাতে ও লাশের উপর নর্তন-কুর্দন করে ইসলামী আদর্শের পতাকাবাহীদের নিঃশেষ করাই ছিল ইসলামবিদ্বেষীদের টার্গেট। নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা ও আনুগত্যের পরম পরাকাষ্ঠা পদর্শন করে জীবন উৎসর্গ করল দ্বীনের মুজাহীদরা কিন্তু পিছু হটল না এককদমও। মিডিয়ার সুবাধে আওয়ামী হায়নাদের বীভৎসতা ভয়ানক তা-ব, নিচুতা ও পাশাবিকতা প্রত্যক্ষ করল বিশ্ব মানবতা। শহীদ ও আহতদের রাজপথে রেখে এক মুহূর্তের জন্য পিছুটান নিল না আন্দোলনের সাথীরা। এ যেন কারবালার আর এক নিষ্ঠুর প্রান্তর। ভাইয়ের সামনে ভাইয়ের লাশ। জান্নাতের মেহমানরা পাখি হয়ে ঘুরছেন জান্নাতে। বছর ঘুরে ২৮ অক্টোবর আসে। শহীদের সাথীরা প্রতিশোধ নেয়ার স্পৃহায় নব উদ্দীপনায় জাগ্রত হয়। আজ আন্দোলনের কর্মীদের কাছে ২৮ অক্টোবর প্রেরণার সুউচ্চ মিনার।
২৮ অক্টোবর ৪ দলীয় ঐক্যজোটের সরকারের মেয়াদকালের পরের দিন নির্বাচনকালীন তত্ত্ববধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ছিল প্রথম দিন। পল্টনে বিএনপি ও বায়তুল মোর্কারম উত্তর গেট ছিল জামায়াতের পূর্ব নির্ধারিত এবং অনুমোদিত সভাস্থল। পাল্টা আওয়ামী লীগও পল্টন ময়দানে সভাকরার ঘোষণা দেয়। এ যেন রাজনীতির চরম শিষ্টাচারিতার লঙ্ঘন। যার কারণে বিএনপি সংঘাত এড়িয়ে নির্ধারিত স্থানে তাদের সমাবেশ না করে নয়া পল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে তাদের কর্মসূচী পালন করছিল। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের ফেরীওয়ালা, বলে এক রকম করে অন্য রকম। তাদের নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে ভয়াল নগ্ন চেহারা তারা সেদিন পদর্শন করে। তাদের কার্যালয় বাদ দিয়ে জামায়াতের নির্ধারিত সভাস্থলে বিনা উস্কানিতে দখলের চেষ্টা করে সাহারা, তোফায়েল, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মায়া, ডাক্তার ইকবাল ও হাজী সেলিমের লগি-বৈঠা বাহিনীর নেতৃত্বে। তাদের গতিবিধি আচার-আচরণে দেশবাসীর কাছে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়েছিল যে এ ধরেনের আচরণ ছিল অত্যন্ত পূর্ব-পরিকল্পিত। চোরা পথে ক্ষমতায় আসার ডিজিটাল নাটকের মঞ্চায়ন। কথিত স্বাধীনতার চেতনার এককদোবিদার আওয়ামী হায়েনাদের তা-বে সেদিন জান্নাতের পাখি হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন টগবগে অকুতোভয় তরুণ শহীদ মুজাহীদ, শিপন, রফিক, ফয়সাল, মাসুম ও শাহজাহান আলী । রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো যারা সৌভাগ্যবানদের কাতারে নাম লিখালেন শহীদ জসিম-১, সাবের, শহীদ জসিম-২, আরাফাত, আব্বাস, রুহুল আমিন, হাবিব ও বয়োবৃদ্ধ জাবেদ আলী। জীবনের স্বপ্ন স্বাদ তাদেরকে মুহূর্তের জন্যও স্থির লক্ষ্য হতে বিচ্যুৎ করতে পারেনি। এ যেন শাহাদাতের পেয়ালা পানের এক অপ্রতিরোধ্য প্রতিযোগিতা। আন্দোলনের সাথীরা ইয়ারমুকের যুদ্ধের ন্যায় পানি পান না করে পাশের ভাইকে পানি পান করানো, নিজের সুরক্ষা নয় আন্দোলনের ভাইয়ের সুরক্ষার জন্য ইস্পাত দেয়াল হয়ে যায়। দুনিয়ার মায়া মমতা যেন তাদের কাছে তুচ্ছ। নিজেরা মজলুম হয়েছিল সেদিন, জালিমের কাতারে শামিল না হয়ে শহীদের কাতারে রিক্ত হস্তে নিজেদের শামিল করে কালের অনাগত বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎস মিনার স্বরূপ। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব চিরন্তন, সত্য-অসত্য কখনো এক হতে পারে না; যেভাবে আলো-আঁধার এক হতে পারে না। দেশে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন হবে, রায়ের মাধ্যমে দেশবাসী তাদের নেতৃত্ব বাছাই করে নেবেÑ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সা¤্রাজ্যবাদীদের নখরে ফ্যাসিবাদীদের জয়ধ্বনিতে বাংলাদেশের রাজধানী থেকে শুরু করে অজপাড়াগাঁয়েও এর আঁচড় লেগেছিল। যে কারণে একটি অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশ তৈরি হলো। যার মাধ্যমে পরবর্তীতে সাজানো নির্বাচন প্রত্যক্ষ করল সমগ্র জাতি। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বললেন ১/১১ আমাদের আন্দোলনের ফসল।
খুন করে ঘটনাস্থল থেকে লাশ চুরি করে অপরাজনীতি করার মতো নির্লজ্জ ইতিহাস উপহার দিতেও আওয়ামী লীগ কুণ্ঠিত হয়নি। ২৮ অক্টোবর কালো অধ্যায় রচনাকারীদের স্বপ্নস্বাদ সাময়িকভাবে বাস্তবায়ন হলেও শহীদের সাথীরা রক্তের বদলা নিতে কফিন ছুঁয়ে আন্দোলনের কাজ পূণোদ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দীপ্ত শপথগ্রহণ করেন। পাতানো নির্বাচনের মাধমে কুৎসিত ফ্যাসিবাদীদের চেহারা পুনরায় প্রকাশ করল আওয়ামী লীগ। সারাদেশে ইসলামপন্থীদের নানা অভিযোগে দমনের ভয়ঙ্কর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো চলতি সরকার। সত্যপন্থীদের জীবন দিয়ে হলেও আন্দোলনের সুরক্ষার তীব্রতায় দিশেহারা হয়ে আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে একটি স্পর্শকাতর কতিথ ‘যুদ্ধপরাধ’ ইস্যু এনে ঘায়েল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন নীল-নকশার সরকার!
সেদিন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা নেতৃত্বের নির্দেশে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সমাবেশ স্থলে অবস্থান করছিলেন । এত লগি-বৈঠার আক্রমণের শিকার একটি দলের নেতা-কর্মীরা স্বাভাবিকভাবে বেপরোয়া ও প্রতিশোধপরায়ণ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু দলের আমীরের গঠনতান্ত্রিক বক্তব্যের মাধ্যমে সবাই হানাহানির পরিবর্তে চরম ধৈর্য্য ধারণ করল। সেদিনের ঘটনা যারা প্রত্যক্ষ করেছিল তাদের অনেকের ভাষ্য মতে- সেদিন যদি দলের আমীরের বক্তব্য বেপরোয়া হতো হয়ত বা পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। আবার ইসলামী সংগঠন ব্যতিত অন্য বৈষয়িক দল হলে সেই ধৈর্য্য ও ক্ষমা প্রদর্শনের নমুনা প্রদর্শন করা সম্ভব হতো কিনা তাও ভাববার বিষয় ছিল।
বাংলাদেশের যেসব প্রান্তরে শহীদের খুন ঝরেছে সেসব প্রান্তরেই আন্দোলন গতিশীল হয়েছে, গণভিত্তি রচিত হয়েছে। ভিন্ন দল-মত ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ দল সম্পর্কে জানার প্রচ- আগ্রহ জন্মেছে। ঢাকা শহরে ২৮ অক্টোবর ছিল দেশের ইতিহাসে জনশক্তির আত্মত্যাগের সবচেয়ে বড় নজির। আন্দোলনের কর্মীরা দৃঢ় চিত্তে মনে করে এ রক্ত কখনো বৃথা যেতে পারে না। রাজধানীর সর্বস্তরের মানুষের কাছে আন্দোলনের আহ্বান পৌঁছে দিয়ে একটি কল্যাণমূলক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়ার মাধ্যমে আমরা এর প্রতিশোধ নিতে চাই।
২৮ অক্টোবরের শহীদ পরিবারগুলোর আত্মীয়দের সাথে যখনই আমরা দেখা করতে গিয়েছি প্রশান্তিতে হৃদয় ভরে গিয়েছে, বার বার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছি। শহীদদের স্বজনদের বক্তব্য আমাদের আন্দোলনের কাজে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রেরণা পেয়েছি। শহীদের মা-বাবা এখনও আমাদের কণ্ঠে মা-বাবা ডাক শুনে তাদের হৃদয়ের অপূরণীয় রক্তক্ষরণ বন্ধ করেন, আন্দোলনের নেতা-কর্মীদেরকে নিজের সন্তান মনে করেন, আমাদের সুখ যেন ওনাদের পরম পাওয়া আমাদের দুঃখ-কষ্ট যেন ওনাদের সবচেয়ে বড় যন্ত্রণার। আমাদের মাঝে তাদের সন্তাদেরকে খুঁজে ফেরেন। তারা আমাদের আপনেরও আপন। আর সন্তানের আত্মত্যাগের চূড়ান্ত মানজিলের সার্থকতার অপেক্ষায় থাকেনÑ ‘কবে এ দেশে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে!’।
দেশের রাজনীতির ইতিহাসে নয়া জঘন্যতম অধ্যায় রচনা করলো আওয়ামী। যে দলের দলীয় প্রধান জনগণের বিরুদ্ধে লাঠি-বৈঠা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন, ষড়যন্ত্রের নীলনকশায় তিনি আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে তার ষড়যন্ত্রের মুখোশ প্রতিনিয়ত উন্মোচিত হতে থাকে। বিরোধী দল মতের উপর চলতে থাকে নির্যাতনের স্টিম রোলার। তার আচরণে বার বার তিনি প্রমাণ করতে চাইছেন তিনি চিরস্থায়ী ক্ষমতার অধিকারী। যা অনাগত কালেও সম্ভব নয়। তার শিকড় বাংলাদেশে নয়, তার শিকড় যেন ভিনদেশে। যে কারণে দেশ ও দশের প্রতি নেই কোন মায়া। একের পর এক পর দেশের সাথে চুক্তি করে সর্বস্বান্ত করে জলাঞ্জলী দিচ্ছেন সবকিছু। বিশেষ করে ইসলামপন্থীদের উপর দমন-পীড়ন দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছে। ২৮ অক্টোবরের শহীদ ও পঙ্গুত্ববরণকারীদের স্বজনরা অপেক্ষায় আছেন খুনিদের বিচারের প্রত্যাশায়। যাদের নির্দেশে একটা শান্ত জনপদ অশান্ত হয়ে গেল, সমাজিক সম্প্রীতি খান খান হয়ে গেল। দেশাভ্যন্তরে ঐক্যের পরিবর্তে বিভেদের কালো মেঘ প্রলেপ করল, কে না চায় তাদের বিচার । সে বিচারের প্রতিক্ষায় বাংলাদেশ। প্রকৃত অপরাধীদের বিচার বাংলার জমিনে হবেই, ইনশাআল্লাহ।
২৮ অক্টোবর আমাদের প্রেরণার সুউচ্চ মিনার। ২৮ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আন্দোলনকে মানজিলে পৌঁছাতে হলে ত্যাগ কুরবানীর বিকল্প নেই। আন্দোলন হলো একটি নির্মাণাধীন ঘর। শহীদরা এ ঘরের চিরস্থায়ী খুঁটি। যারা জীবন্ত শহীদ হাত-পা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে আমাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে বারবার তাকিয়ে একটি প্রত্যাশিত দিনের জন্য প্রতিক্ষা করছে তারা ঘরের ছাদ। এখানে আন্দোলনের কর্মীরা ছায়া নেয়, উজ্জীবনী শক্তি সংগ্রহ করে সম্মুখে এগিয়ে চলে সাহসের সাথে দ্বিধাহীন সোজা রাজপথে। এখানে কেউ কেউ এই ঘরের চিরস্থায়ী অধিবাসী হয়ে যান অনন্ত কালের অনাগত ভবিষ্যতের জন্য প্রেরণার চিহ্ন স্বরূপ। এ পথে শাহাদাত, ত্যাগ, কুরবানী স্বাভাবিক পরিক্রমা। কেউ শহীদ কেউ বা গাজী। কারণ খোদাদ্রোহী জনপদকে বদলে দেয়ার চ্যালেঞ্জ সমাজের নরখাদকদের মুখে এক প্রচ- চপেটাঘাত। আর মুক্তিকামী হেরার রাহের যাত্রীদের কাছে এর বিকল্প কোন মঞ্জিল খোলা নেই।
কবি আল-মাহমুদের কবিতায় (আমাদের মিছিল) সে কথার প্রতিধ্বনি যেন বারংবার অনুরণিত হচ্ছে-
আমাদের এই মিছিল নিকট অতউত থেকে অনন্ত কালের দিকে
আমরা বদর থেকে ওহুদ হয়ে এখানে,
শত সংঘাতের মধ্যে এ শিবিরে এসে দাঁড়িয়েছি।
কে জিজ্ঞেস করে আমরা কোথা যাব?
আমরাতো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের।
উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোনদিনই বিহ্বল করতে পারেনি।
আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত।
আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মোতার প্রান্তর।
পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত।
লেখকঃ মুহাম্মদ আবদুল জব্বার
সেক্রেটারী জেনারেল, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির