Home Article মানবতাবিরোধী অপরাধের এক কলঙ্কজনক দিবস ২৮ অক্টোবর

মানবতাবিরোধী অপরাধের এক কলঙ্কজনক দিবস ২৮ অক্টোবর

আটাশ অক্টোবর বাংলাদেশের ইতিহাসে মানবতাবিরোধী অপরাধের এক কলঙ্কজনক দিবস। ২০০৬ সালের এই দিনে যে নির্দয়, নিষ্ঠুর ও পাশবিক কায়দায় আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা নরহত্যায় মেতে উঠেছিল তা শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে হতবাক করেছে। এ নির্মম হত্যাকাণ্ড ও পাশবিকতায় কেঁদেছে বাংলাদেশ, কেঁদেছে বিশ্বমানবতা। প্রকাশ্য দিবালোকে লগি, বৈঠা ও মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সেদিন যে হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছিল তা ইতিহাসে বিরল। মৃত লাশের উপর নৃত্য করার দৃশ্য দেখে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক ধারাকে ব্যাহত করা হয়েছে।

ঘটনা যেভাবে শুরু

২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। মূলত এ ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই দেশব্যাপী শুরু হয় লগি-বৈঠার তাণ্ডব। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-জামায়াত অফিসসহ নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি যেমন চালানো হয় পৈশাচিক হামলা, তেমনি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় অনেক অফিস, বাড়িঘর, পুরো দেশব্যাপী চলে তাণ্ডবতা।

২৮ অক্টোবর চারদলীয় জোট সরকারের ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশ ছিলো বিকাল ৩টায়। সকাল থেকেই সভার মঞ্চ তৈরির কাজ চলছিল। হঠাৎ করেই বেলা ১১টার দিকে আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠা ও অস্ত্রধারীরা জামায়াতের সমাবেশ স্থলে হামলা চালায়। তাদের পৈশাচিক হামলায় মারাত্মক আহত হয় জামায়াত ও শিবিরের অসংখ্য নেতা-কর্মী। তাদের এই আক্রমণ ছিল সুপরিকল্পিত ও ভয়াবহ। এক পর্যায়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পল্টনের বিভিন্ন গলিতে ঢুকে পড়ে এবং নিরীহ জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের বেধড়ক পেটাতে থাকে।

লগি-বৈঠার পৈশাচিকতা

সেদিন পুরো পল্টন জুড়ে ছিল লগি-বৈঠা বাহিনীর তাণ্ডব। লগি-বৈঠা আর অস্ত্রধারীদের হাতে একের পর এক আহত হতে থাকে নিরস্ত্র জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা। তারা শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলামকে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। লগি-বৈঠা দিয়ে একের পর এক আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করে জামায়াত কর্মী জসিম উদ্দিনকে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তারা তার লাশের উপর ওঠে নৃত্য-উল্লাস করতে থাকে।

কেন এই নৃশংসতা

সেদিন আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠা বাহিনী শুধু জামায়াতের সভা-পণ্ড করার জন্যই পৈশাচিক হামলা চালায় নি তারা জামায়াতকেই নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল জামায়াতের সভামঞ্চ গুঁড়িয়ে দিতে। প্রথম দফা হামলার পর তারা ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকে। আশপাশের ভবনের ছাদে উঠে বোমা ও বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রসহ অবস্থান নেয়। সভার শেষ দিকে মাওলানা নিজামীর বক্তব্য শুরু হলে তারা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পুনরায় হামলা চালায়। একদিকে ভবনের ছাদ থেকে বৃষ্টিরমতো বোমা বর্ষণ করতে থাকে। অপরদিকে পল্টন মোড় থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে লগি-বৈঠাধারীরা সমাবেশের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা তৈরি করে মানব ঢাল। এ সময় আওয়ামী অস্ত্রধারীদের ছোঁড়া গুলি মাথায় বিদ্ধ হয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়েন জামায়াত কর্মী হাবিবুর রহমান ও জুরাইনের জামায়াত কর্মী জসিম উদ্দিন। এ ঘটনায় জামায়াত ও শিবিরের ৬ জন নেতাকর্মী শহীদ ও ৬ শতাধিক আহত হন।

পূর্ব পরিকল্পিত হামলা

জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে বিকালে সমাবেশের জন্য সকাল থেকেই মঞ্চ তৈরির কাজ চলছিল। এ জন্য মঞ্চ তৈরির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ছাড়াও জামায়াত ও শিবিরের কয়েকজন নেতাকর্মী কাছাকাছি অবস্থান করছিল। এ সময় ১৪ দলের নেতাকর্মীরা জিরো পয়েন্ট এলাকায় অবস্থান করছিল। তাই জামায়াত ও ১৪ দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি অবস্থানের কোনো সুযোগ ছিল না। বিকালে সমাবেশ হওয়ার কারণে সকালে মঞ্চ তৈরির সংশ্লিষ্ট লোক ছাড়া মিছিল করার মতো জামায়াত ও শিবিরের কোনো নেতাকর্মী ছিল না। হঠাৎ করেই সকাল ১১টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিমের নেতৃত্বে লালবাগ থানা আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠা হাতে বিশাল মিছিল নিয়ে পল্টন মোড়ে আসে। মিছিলকারীরা ‘ধর’ ‘ধর’ বলে জামায়াত ও শিবিরের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় জিপিও এলাকায় অবস্থানরত ১৪ দলের শত শত কর্মী লগি-বৈঠা নিয়ে তাদের সাথে যোগ দেয়। ১৪ দলের কর্মীরা প্রকাশ্যে গুলি করা ছাড়াও লগি-বৈঠা নিয়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একের পর এক আঘাত হানতে থাকে নিরীহ জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের ওপর। মঞ্চ গুঁড়িয়ে দিতে এগিয়ে যেতে থাকে বায়তুল মোকাররম উত্তর সড়কের দিকে। এ হামলায় পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা ডা. এইচবিএম ইকবাল ও তার বাহিনী নিয়ে যোগ দেয়।

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ডা. ইকবালকে যখন হাত নেড়ে নির্দেশ দিতে দেখা যায় তারপরই এক যুবককে ঘেরাও করে লগি-বৈঠা বাহিনী নির্মমভাবে পিটাতে থাকে। চতুর্দিক থেকে আঘাতে আঘাতে সে পড়ে যায় রাস্তার কিনারে। সাপের মতো লগি-বৈঠা দিয়ে তাকে পিটাতে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তার লাশের ওপর উঠে নারকীয় উল্লাস করে লগি-বৈঠা বাহিনী। বিকল্প পথে মঞ্চ দখলের জন্য বিজয়নগর, পল্টন মসজিদের গলি দিয়ে ঢুকে পড়ে লগি-বৈঠা বাহিনী। যেখানেই দাড়ি টুপি দেখেছে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা। শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলামকে তারা এ সময় পেয়ে যায় পল্টন মোড়ের কাছে। ঘিরে ধরে তাকে। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে নরপিশাচরা। আঘাতে আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মুজাহিদ। তারপর ঐ পিশাচরা লগি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নিজেদের জিঘাংসা চরিতার্থ করে।

আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ, বোমা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের পর আহতদের সারি বেড়েই চলছিল। আহতদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় জামায়াতের ঢাকা মহানগরী অফিসে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। গুরুতর আহতদের নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দফায় দফায় হামলা চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। এ সময় বারবার পুলিশকে অনুরোধ করা হলেও তারা রাস্তার পাশে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। অনেক পুলিশকে সেদিন বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর চত্বরের ভিতরে অবস্থান নিতে দেখা যায়।

বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে জামায়াতের সমাবেশ শুরু হয়। এ সময় পল্টন মোড়ের দিকে না হলেও বিজয়নগরসহ অন্যান্য এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে থাকে লগি-বৈঠা বাহিনী। তবে সমাবেশ স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকে। যথারীতি আসর নামাজের বিরতি হয়। বিরতির পর বক্তব্য রাখেন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মাওলানা আবদুস সুবহান, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। সভাপতি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঢাকা মহানগরী আমীর মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান। এরপরই বক্তব্য দিতে দাঁড়ান জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী।

মরণ আঘাত

মাওলানা নিজামীর বক্তব্য শুরু হওয়ার ৪/৫ মিনিট পর ৪টা ৪৩ মিনিটে পল্টন মোড়ে উত্তেজনা দেখা যায়। এ সময় নির্মাণাধীন র‌্যাংগস টাওয়ারের (বাসস ভবনের পূর্ব পাশের বিল্ডিং) ছাদ থেকে সমাবেশ লক্ষ্য করে ১০/১২টি বোমা ও প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে দফায় দফায় গুলি ছুঁড়ে ১৪ দলের সন্ত্রাসীরা। এ সময় পুলিশ নিজেদের নিরাপদ স্থানে হটিয়ে নেয়। আবার শুরু হয় ১৪ দলের মরণ কামড়ের মতো আক্রমণ। সমাবেশ ভণ্ডুল করে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। মাগরিবের আজানের পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসে যখন বিডিআর পল্টন মোড়ে অবস্থান নেয়। এর আগে সমাবেশের কোনো বক্তাই উত্তেজনাকর বক্তব্য দেননি, আক্রমণাত্মক কথাও বলেননি কেউ।

লাশ নিয়ে সেই পুরনো রাজনীতি

লাশ নিয়ে রাজনীতি আওয়ামী লীগের জন্য নতুন কিছু নয়। সেদিন মহাজোট কর্মীরা জামায়াত কর্মী হাবিবুর রহমানকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি লাশটি টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল গুম করার জন্য। কিন্তু পুলিশের সহায়তায় যখন লাশটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলো সেখানেও চলতে থাকে আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিম বাহিনীর লাশ দখলের খেলা। তারা নকল বাবা মা সাজিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল লাশটি। পরবর্তীতে এ কারসাজি ধরা পড়ায় নকল বাবা মা সটকে পড়ে। এখানেই শেষ নয়। আওয়ামী লীগ হাবিবুর রহমানকে নিজেদের কর্মী দাবি করে তার লাশের ছবি ব্যবহার করে পোস্টারও ছেপেছিল। লাশ নিয়ে রাজনীতি এর চেয়ে জঘন্য নমুনা আর কী হতে পারে?

পুলিশের রহস্যজনক নীরবতা

ঘটনার শুরু থেকেই পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যময়। পুলিশের উপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগের আগ্নেয়াস্ত্র ও লগি-বৈঠাধারী সন্ত্রাসীরা জামায়াতের সমাবেশ স্থলে হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। অসহায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের শত অনুরোধেও পুলিশ কোনো ভূমিকা রাখেনি।

জামায়াতের সমাবেশে সেদিন ২ জন পূর্ণ মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। সে সময়কার উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতেও মন্ত্রীদের জন্য কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়নি। তাদের জন্য নির্ধারিত ২ জন গানম্যান ছাড়া আর কেউই ছিলো না। এমনকি বিকেলে সমাবেশ চলাকালে যখন প্রকাশ্যে বোমা ও গুলি ছোঁড়া হয়, তখনও ঐ ২ জন মন্ত্রী ছিলেন অরক্ষিত।

২৮ অক্টোবরের আগ থেকেই পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছিল, লগি-বৈঠা, কাস্তে বা অন্য কোনো অস্ত্রশস্ত্র বহন নিষিদ্ধ ও বেআইনী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু পুলিশ এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আওয়ামী লীগের অফিসে লগি-বৈঠা সংরক্ষণ করা হচ্ছে বলে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করলেও পুলিশ এ ব্যাপারে ছিল নীরব।

মহাজোট নেতারা কী দায় এড়াতে পারেন না?

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে কর্মীদের লগি-বৈঠা হাতে তুলে নেয়ার ঘোষণায় ঢাকাসহ সারাদেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তিনি ২০০৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশ্য জনসভায় লগি, বৈঠা নিয়ে ঢাকায় অবরোধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপরই আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের কর্মীরা লগি, বৈঠা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ২৭ অক্টোবর থেকেই সারাদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ২৮ অক্টোবর তারা ব্যাপকভাবে সংঘটিত হয়ে জামায়াতের সমাবেশে হামলা চালায়।

২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের মুক্তাঙ্গনের সমাবেশ থেকে বার বার ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল “জামায়াত-শিবিরের উপর হামলা কর’ ওদেরকে খতম কর! ১৪ দলীয় জোট ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল, তোফায়েল আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন বার বার উত্তেজনাকর বক্তব্য দিয়ে সন্ত্রাসী বাহিনীকে উৎসাহিত করছিল।

দেশব্যাপী নৈরাজ্য ও হত্যাকাণ্ড

সারা দেশে পরিকল্পিতভাবে হত্যা ও নৈরাজ্য পরিচালনা করা হয়। ২৭ অক্টোবর গাজীপুরে হামলা চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জামায়াতে ইসলামী গাজীপুর জেলার প্রচার সম্পাদক, জেলা শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি মুহাম্মদ রুহুল আমীনকে। ২৭ থেকে ২৯ অক্টোবর ঢাকাসহ সারাদেশে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবে জামায়াত-শিবিরসহ চারদলীয় জোটের ৫৪ জন নেতা-কর্মী শাহাদাত বরণ করেছেন। আহত হয়েছে ৫ সহস্রাধিক জামায়াত, শিবির, বিএনপি নেতাকর্মী, সাংবাদিক, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ। এ পৈশাচিকতা ও বর্বরতার হাত থেকে রেহাই পায়নি মায়ের কোলের শিশু, নারী, বৃদ্ধ এবং নিরীহ জনগণও। তাদের তিনদিনের ধ্বংসলীলায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।

এরাও কী মানুষ!

ওরা শুধু প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে মুজাহিদ, জসিম আর শিপনকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি জরুরি প্রয়োজনে রাস্তায় বের হওয়া নারী, শিশু ও খেটে খাওয়া মানুষরাও রেহাই পায়নি আওয়ামী নরপিশাচদের কবল থেকে। তারা এতোই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে, তারা একান্ত নিরীহ অসহায় হতভাগ্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছোটখাটো দোকানদার এবং ফুটপাতের হকারদেরও তাদের নারকীয় তাণ্ডবের হাত থেকে রেহাই দেয়নি। বৈঠার আঘাতে যেমনি তাদের দোকান ভাঙচুর করেছে, তেমনি ফুটপাতে সাজানো হকারদেরও বিক্রয়যোগ্য দ্রব্যসমূহ জড়ো করে তাতে আগুন ধরিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। যেসব হকার ও খুদে দোকানদার লগি-বৈঠাধারীদের বাধা দিয়েছে বা পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেছে, তাদের পিঠে চালিয়েছে বৈঠা আর লগির বাড়ি আর পেটে মেরেছে লাথি। এমনি এক হকার কাসেম মিয়া পল্টন এলাকায় বুক চাপড়াতে চাপড়াতে আর্তনাদ করে পাগলের মতো দৌড়াচ্ছিল আর বলছিল “আমি পথের ফকির অইয়া গেলাম। আমি অহন আত্মহত্যা করুম”। লগি-বৈঠার তাণ্ডবের পথ ধরেই দেশে ১/১১ হয়েছিল। তার পথ ধরেই ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার আজ ক্ষমতায়। লগি-বৈঠার সেই তাণ্ডব থেমে নেই। এই অক্টোবরেই একই কায়দায় নাটোরের বড়াইগ্রামে উপজেলা চেয়ারম্যানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সাভারের আমিনবাজরেও পিটিয়ে ছাত্রদের মারা হয়।

আবারো লগি-বৈঠার পদধ্বনি

এক শ্রেণীর রাজনীতিকের ক্ষমতালিপ্সা কত জঘন্য, নৃশংস হতে পারে, রক্তাক্ত সেই আটাশ অক্টোবর ২০০৬ তার দৃষ্টান্ত হতে পারে। একটি গণতান্ত্রিক সরকার তার মেয়াদ শেষে যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করছিল, যখন প্রশাসনও একটা অন্তর্বর্তী অবস্থানে দাঁড়িয়েছিল, সেই সময়ের সুযোগ নিয়ে সেদিন যে সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তা মানুষের স্মৃতিকে বহুকাল পীড়িত করবে। আটাশ অক্টোবর বারবার আমাদের মাঝে ফিরে আসে। আর স্মরণ করিয়ে দেয় লগি-বৈঠার সেই তাণ্ডব। লগি-বৈঠার পৈশাচিক নৃত্যের কথা স্মরণ হলে শিউরে উঠে মানুষ। মানবতা বিরোধী এই জঘন্য অপরাধের বিচার কি এই বাংলার মাটিতে হবে না? স্বজন হারা পরিবারগুলো সেই দিনটির জন্যই তাকিয়ে আছে।

যারা সে দিন রাজপথে পিটিয়ে মানুষ হত্যার পর লাশের উপর উল্লাস-নৃত্যের মতো হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটিয়েছিল, তারা আজও সক্রিয়। গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও অধিকারকামী মানুষের উপর হত্যা, গুম, নির্যাতন, মামলা-হামলার অসহনীয় অবস্থা চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সেই শক্তিই আজ দেশে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে এবং মানুষের অধিকারের ধ্বংসস্তুপের উপর আরেকটা সাজানো নির্বাচনের ষড়যন্ত্র করছে।

এর শেষ কোথায়?

২৫ অক্টোবরকে ঘিরে দেশে এখন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে সর্বদলীয় সরকারে নাম দেয়ার প্রস্তাব, বিরোধী দলের উত্তর দেয়ার আগেই হঠাৎ করে ঢাকা মহানগরীতে সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে দেশ আরেকটি অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা করলো। কাঁচপুর ব্রিজ দখল করে কাউকে ঢাকায় প্রবেশ করতে না দেয়ার হুমকি, লালদিঘি ময়দান দুই দিন দখলে রাখার ঘোষণাও গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য শুভকর নয়। লগি-বৈঠা আর দা-বটি নিয়ে মাঠে নামার ঘোষণা আতঙ্কিত করে দেশবাসীকে। রাজনীতির এ খেলায় প্রাণ হারায় নিরীহ মানুষ, খালি হয় মায়ের বুক, রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। কিন্তু এর শেষ কোথায়?

লেখকঃ সামছুল আরেফীন

SHARE